ব্রেকিং:
এক জালে মিলল ৫৫০০ পিস ইলিশ, ১৭ লাখে বিক্রি ছোট ভাইকে ‘কুলাঙ্গার’ বললেন মির্জা কাদের শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের পুনর্জন্ম ফেনীতে কিশোর গ্যাং পিএনএফের প্রধানসহ গ্রেফতার ৫ সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্র গেলেন সেনাপ্রধান সৌদি পৌঁছেছেন ১৭ হাজার ১৪১ হজযাত্রী সুবর্ণচরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ সাবেক মন্ত্রীর ৪ ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা নিজ্জর হত্যাকাণ্ড: কানাডায় আরো একজন ভারতীয় গ্রেফতার ‘দেশে তেলের সঙ্গে কমবে-বাড়বে বিদ্যুতের দামও’ হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক আজ বিশ্ব মা দিবস জলদস্যুর কবলে পড়া সেই জাহাজ এখন বাংলাদেশের জলসীমায় কেএনএফের সভাপতি সানজু খুম বম গ্রেফতার নিজ এলাকায় পরবাসী হলেন ওবায়দুল কাদের দুই বাংলাদেশির মরদেহ ফেরত দিল বিএসএফ ঢাকায় মনোনীত নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কে এই ডেভিড মিল ঋণ শোধের সক্ষমতা অর্জন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নোয়াখালীতে হেরে গেলেন ওবায়দুল কাদের পতেঙ্গায় আগুন ধরে প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলীতে, ২ পাইলট আহত
  • শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ক্ষীণ আশার আলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায়

নোয়াখালী সমাচার

প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২২  

২২ জুলাই বেলা ৩টায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের (আইসিজে) সভাপতি ও বিচারক জোয়ান ই ডনোগুই আদালতের যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, তাকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বললে ভুল হবে না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে একটি মামলায় দেশটির আপত্তির বিষয়ে আইসিজে তার রায় ঘোষণা করেছেন। রায় দেওয়া হয় মানবতার পক্ষে এবং অপরাধের বিরুদ্ধে। বিশ্ব আদালত মিয়ানমারের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে, মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির পথ প্রশস্ত করে।

এটি রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মতো নির্যাতিত মানুষদের বিজয়ের শুরু। এখন মিয়ানমারের সব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মনে আশা জাগবে যে, আজ হোক কাল হোক, অপরাধের শাস্তি হবেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতা, তাদের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিশ্ববিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। মিয়ানমারের দুরভিসন্ধিমূলক প্রাথমিক আপত্তির আইসিজেতে ‘গণহত্যার মামলা’ আমলযোগ্য করার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ঠিক আগে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার প্রাথমিক আপত্তি দাখিল করেছিল এবং যুক্তি দিয়েছিল যে, আদালতের এ মামলার শুনানির এখতিয়ার নেই। তাছাড়া, মিয়ানমার মামলাটি খারিজ করার চেষ্টা করছিল এই ভিত্তিতে যে, আফ্রিকান দেশ গাম্বিয়া ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনে’র প্রক্সি হিসাবে কাজ করছে এবং আদালত কেবল জড়িত দেশগুলোর মধ্যে (কোনো অরগানাইজেশন নয়) মামলা শুনতে পারে। কিন্তু প্রিসাইডিং বিচারক জোয়ান ই ডনোগুই বলেছেন, ১৩ বিচারকের প্যানেল দেখেছে যে, ‘১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনে’র সব সদস্য গণহত্যা প্রতিরোধে বাধ্য, এমনকি তা প্রতিহত করতে উদ্যোগ নিতে পারে (যেমনটি গাম্বিয়া করেছে) এবং এ মামলায় আদালতের এখতিয়ার রয়েছে।

আইসিজে গাম্বিয়ার অভিযোগটি গ্রহণ করায় এটি এখন মামলা হিসাবে আমলযোগ্য হয়েছে এবং একটি চূড়ান্ত রায়ের দিকে ধাবিত হবে। গাম্বিয়া অভিযোগ করেছিল, মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গা গণহত্যাটি ‘গণহত্যা কনভেনশনে’র অধীনে পড়ে, যেখানে দুটি মাত্রা বা ধরনের কথা বলা হয়েছে। একটি গণহত্যার অভিপ্রায় এবং অন্যটি গণহত্যা কার্যসম্পাদন। ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ হিসাবে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিপীড়নের মধ্যে রয়েছে-রোহিঙ্গাদের আইনি অধিকারকে অস্বীকার করা, তাদের বিয়ে ও সন্তান ধারণের ক্ষমতার ওপর বিধিনিষেধ, চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ এবং গোষ্ঠীটিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিস্তৃত ঘৃণামূলক প্রচারণা চালানো। অন্যদিকে মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যামূলক কাজে’র মধ্যে রয়েছে-অক্টোবর ২০১৬ এবং আগস্ট ২০১৭-এর ঘটনাগুলো; রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের গণহত্যাসহ ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’; গোষ্ঠীটিকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে দেওয়া; শিশুদের টার্গেট করা এবং ব্যাপকহারে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা করা। সেই ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

যেহেতু গাম্বিয়ার অভিযোগটি এখন গণহত্যা মামলা হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, তাই ভবিষ্যতে আইসিজে অভিযুক্তের (মিয়ানমার) বিরুদ্ধে এবং ভিকটিম (রোহিঙ্গা) বা বাদীর (গাম্বিয়া) পক্ষে যায় এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ৯৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সদস্য দেশকে অবশ্যই আইসিজের সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলতে হবে, যদি তারা একটি পক্ষ দেশ হয় এবং ওই দেশ যদি সিদ্ধান্ত মানতে অসম্মতি জানায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারে। গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের একটি উপযুক্ত ট্রাইব্যুনালের সামনে জবাবদিহি করা এবং তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা আইসিজে করতে পারে এবং গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করতে পারে। যাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারসহ নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে পারে আইসিজে। তাছাড়া আইসিজে এখন মিয়ানমারের কাছ থেকে আশ্বাস ও গ্যারান্টির ব্যবস্থা করতে পারে যে, তারা গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি করবে না।

কিন্তু সেসব আশা কিছুটা অনিশ্চিত রয়ে গেছে। কারণ মিয়ানমারের ক্ষমতা এখন নৃশংস সেনাবাহিনীর হাতে, যারা প্রধান অভিযুক্ত। ২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সেনাবাহিনী দেশজুড়ে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্যমান ছয় লাখ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ, এমনকি নৃশংসতা অব্যাহত রয়েছে এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী সামরিক শাসন আরও রোহিঙ্গা গণহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। একই জেনারেলরা, যারা ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারাই এখন সামরিক শাসনের নেতৃত্বে রয়েছেন। এর ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারির আইসিজের অন্তর্বর্তী রায়ের বাস্তবায়ন কিছুটা ঝুঁকিতে রয়েছে। তখন আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন মিয়ানমার সরকারকে। সেগুলো হলো-গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়নমূলক কাজ থেকে মিয়ানমারকে নিবৃত্ত থাকা, দেশটির সামরিক, পুলিশ বা অন্য কোনো অনিয়মিত বাহিনী যাতে এর দ্বারা সমর্থিত বা পরিচালিত হয় বা তার নিয়ন্ত্রণে গণহত্যামূলক কাজ না করে তা নিশ্চিত করা; গণহত্যামূলক কাজের সব প্রমাণ সংরক্ষণ করা এবং আদালতের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে একটি স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেওয়া।

পূর্ববর্তী মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইসিজের আংশিক বা সম্পূর্ণ রায় কার্যকর হয়েছে, যদি জড়িত পক্ষ বা দেশগুলোর ক্ষমতায় গণতান্ত্রিক সরকার থাকে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সামরিক জান্তা আইসিজেতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ গ্রহণ করলে বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) দাবি করে যে, এটি দেশের বৈধ প্রতিনিধি। উৎসাহব্যঞ্জক দিক হলো, এনইউজি আনুষ্ঠানিকভাবে আইসিজের এখতিয়ারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সব প্রাথমিক আপত্তি প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (আইসিজের রায়ে সব আপত্তি এখন বাতিল) এবং মামলার সব কাজে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নৃশংসতার জন্য মিয়ানমারকে জবাবদিহি করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো আইসিজের বিচার প্রক্রিয়া। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দায়মুক্তি ও জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি থাকায় আইসিজেতে চলমান গণহত্যা মামলাটি এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে আশার আলো দেখাবে। তাছাড়া আইসিজের এমন সিদ্ধান্ত আইসিসি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) ও আর্জেন্টিনায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান মামলাকে তেজোদীপ্ত করবে। এসবের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও বেগ পাবে বলে মনে করি।

তন্ময় চৌধুরী : শরণার্থী ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক