ব্রেকিং:
পুকুর থেকে মাদরাসা ছাত্রীর লাশ উদ্ধার বাংলাদেশি জিনাতের সোনা জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বক্সিংয়ে নিয়মিত দ্বিগুন মাত্রার শব্দে দূষণের শিকার কুমিল্লা নগরী দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধ-র্ষ-ণে-র অভিযোগ দেশের যত অপরাধ তার সবই করে বিএনপি: প্রধানমন্ত্রী শিশু সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যা বিশেষ কায়দায় ৪০ কেজি গাঁজা পাচার দুদিনব্যাপী পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রশিক্ষণ ৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধন ৪ নভেম্বর দুর্গাপূজা: দেশজুড়ে মণ্ডপের নিরাপত্তায় ২ লক্ষাধিক আনসার-ভিডিপি ১৫ বছরে ধানের ৮০ নতুন জাত ঢাকা-না’গঞ্জ লিঙ্ক রোড ছয় লেন হচ্ছে চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস ফিলিস্তিনের জন্য বাংলাদেশে আজ রাষ্ট্রীয় শোক আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে আজ বার কাউন্সিলের নতুন ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী হামানকর্দ্দির কামাল গাজীকে আসামী করে সদর মডেল থানায় মামলা টিকটকে প্রেমের পর বিয়ে, ৩ বছরের মাথায় তরুণীর আত্মহত্যা লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে উপনির্বাচন : প্রতীক পেলেন প্রার্থীরা
  • শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জনক হারানোর মাস

নোয়াখালী সমাচার

প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০১৯  

আগস্ট আমাদের জনক হারানোর মাস। এ মাসের পনের তারিখ আমরা আমাদের জনককে হারিয়েছিলাম। তাই চোখে জল নিয়ে উচ্চারণ করি কবি শামসুর রাহমানের সেই অমর লেখা-
‘ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা
যার নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া 
ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে 
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’

পিতাকে নিয়ে লেখা এ কবিতা পুরোনো হয় না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতি স্মরিত হবে ততদিন। পিতার উদ্দেশ্যে লেখা এ কবিতা ধ্বনি তুলবে কোটি কণ্ঠে বার বার, হাজার বার। 

১৫ আগস্ট ১৯৭১,  কোটি কোটি বাঙালি তাদের পিতাকে হারিয়ে ফেলেছিল। সারা জাতি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কাঁদতে পারেনি ভয়ে। সে এক অসহনীয় সময়, যন্ত্রণাকাতর দিন-রাত। পিতা হারিয়ে গেছে, বুকে পাষাণভার। তবু চোখ থেকে পানি পড়া বারণ, আর্তি আহাজারি করা বারণ। যে সঙ্গীন কেড়ে নিয়েছিল জাতির পিতা আর তার পুরো পরিবারকে, সে সঙ্গীনের ভয়ে কাঁদতে পারেনি বাঙালি জাতি। শুধু যাদের বুকে সঙ্গীন ধরা যায় না সেই স্বাধীন দেশের আকাশ বাতাসে ধূলিকণা কেঁদেছিল, বাঙালি ফেলেছিল নীরব দীর্ঘশ্বাস! 

কী ভয়ঙ্কর, কী নিষ্ঠুর আর কী ভয়াল ছিল সেই দিন রাত! ওই রাতে স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রাজি জামাল, সহোদর, আত্মীয় পরিজনসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির জনক। সেই হত্যাযজ্ঞে আরো শহিদ হন বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবত, শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। জাতি আজও গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এসব শহিদকে। 

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি যে নৃশংস গণহত্যা ঘটায় তার সাথে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতের বর্বরতাকে তুলনা করা যেতে পারে। সেদিন নারী শিশু বৃদ্ধা বৃদ্ধা না মেনে নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। সেদিন গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি। আর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে গণহত্যা চালালো পাকিস্তানি হানাদারদেরই এদেশীয় দোসর কিছু বিশ্বাসঘাতক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কিছু রাজনীতিক। সঙ্গে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে শহিদ হলেন সেই কালরাতে। প্রবাসে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। 

কী হয়েছিল সেদিন! মহান মুক্তিযুদ্ধের তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি। সারাদিনের অফুরন্ত কাজ শেষে কর্মক্লান্ত বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য দিনরাত কাজ করছেন তিনি। হঠাৎই একদল বিপথগামী তরুণ সেনা ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘিরে  ফেলল তার বাড়িটি। তখন সুবহে সাদিকের সময়। পবিত্র আজানের ধ্বনি মুখরিত করছে দিকবিদিক। সে আজান ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ছুটে এলো ঘাতকের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ল সেগুলি। একে একে শহিদ হলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ এক পরিবারের সদস্যরা। 

বাড়ির সিঁড়িতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে ছিল জাতির জনকের মৃতদেহ। এদিক ওদিক ছড়ানো-ছিটানো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজি জামাল কনিষ্ঠপুত্র রাসেলসহ অনেকের লাশ। এই সেই শেখ মুজিব, বাংলার মানুষই যাকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছিল। আর এ বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সাথে ছিল তার প্রাণের  যোগ, অটুট বন্ধন, আত্মার আত্মীয়তা। কোটি বাঙালির হৃদয়ে ছিল তার প্রতিচ্ছবি, যা এখনো দেদীপ্যমান। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সবার মনে। 

ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে তার কিছুই ছিল না। জনগণের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলেন। জনগণ এবং তাদের ভালবাসাই ছিল তাঁর একমাত্র সম্পদ। যে সম্পদ  কেড়ে নেয়া যায় না। ১৫ আগস্ট এলে বার বার সে সত্য উপলব্ধি করা যায়। 

কোনো বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারে এমন আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর মনে বিন্দুমাত্র ছিল না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ঘনিষ্ঠজন তাকে বার বার অনুরোধ করেছিল সুরক্ষিত স্থানে থাকতে। তাদের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গভবনের মতো সুরক্ষিত স্থানে না থেকে থেকেছেন ধানমিন্ডতে অরক্ষিত নিজ বাড়িতে। 
আর সেই সুযোগই নিয়েছে ঘাতকেরা। বঙ্গবন্ধুর এই হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও মর্মান্তিক ঘটনা। মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিঙকন, পেট্রিস লুমুম্বা, এডওয়ার্ড কেনেডি, ইন্দিরা গান্ধীও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এদের কাউকে বঙ্গবন্ধুর মতো সপিরবারে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়নি।  পাকিস্তানীরা যা করেনি, করতে সাহস পায়নি তাই করল বঙ্গবন্ধুর আশে পাশে থাকা এদেশের ঘাতকরা। 

ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যায়, নারকীয় এই সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ কিছু সদস্য এং বিপথগামী কিছু সামরিক কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের সহকর্মী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। সংবাদ মাধ্যমে এ হত্যাকান্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএকে দায়ী করা হয়। 

১৬ আগষ্ট তার মরদেহ জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কঠোর প্রহরায় ছিল ঘাতকরা। মাত্র পনের মিনিটে সামরিক তত্ত্বাবধানে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়া হয় হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটিকে। বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয় পরিবারের অন্য সদস্যদের। তাকে দাফন করা হয়েছিল রেডক্রসের কাপড় দিয়ে। আশপাশের একজন মানুষ, একজন আত্মীয়কেও আসতে দেয়া হয়নি শেষবারের মতো একটিবার পিতাকে দেখতে। 

তারপর  বহুবছর পনের আগস্ট ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয়ভাবে  শোক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। এছাড়াও বিধি সংশোধন করে সরকারিভাবে নির্ধারিত দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার মাধ্যমে দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পুনর্বহাল করে। 

খন্দকার মুশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইনডেমনিটি ( দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। যা ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট সংসদে রহিত করা হয়। 

এরপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক কার্যক্রম। দীর্ঘ কাঁকর বিছানো পথ ডিঙিয়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্তকৃত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব), সুলতান শাহরিযার রশিদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা,  লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ( ল্যান্সার ) এবং লে. কর্নেল (অব) মুহিউদ্দিন আহমেদকে( আর্টিলারি) ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য খুনিদের এখনো দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি সরকার। তাই এখনো শাপমুক্ত হয়নি বাঙলার মাটি। 

শেখ মুজিব এক মৃত্যুজয়ী বীর, যিনি জীবনের শেষক্ষণেও ছিলেন দৃঢ়চেতা। একজন মহান জাতীয়তাবাদী নেতার দৃশ্রত মৃত্য ঘটে সেদিন তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। যিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরে বুনে দিয়েছিলেন বাঙালিত্বের চেতনা। আজীবন লড়াই করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন ভালবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন  যে বন্ধন  কোনোদিন ছিন্ন হওয়ার নয়। তাই আজো মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকে।  বেগম সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, ‘এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী/ ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া অসিতে যদি / হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা/এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা- বোন-ভ্রাতা। 

ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু জনগণের মন  থেকে তার স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। তাদের অন্তরে গ্রোথিত রয়েছে তার ত্যাগ ও তিতিক্ষার সংগ্রামী জীবনাদর্শ।