ব্রেকিং:
১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করবে সরকার সংকট উত্তরণের বাজেট বিমানে মন্ত্রী-সচিবদের প্রথম শ্রেণিতে বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত পিপিপি’র পাইপলাইনে নতুন ১৩ মেগা প্রকল্প সরকারের পদক্ষেপে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধ হয়েছে প্যানেল স্পিকার হলেন কুমিল্লার প্রাণ গোপাল দত্ত ও আঞ্জুম সুলতানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ করুন সরকারের ঋণ কমেছে ২৩ হাজার কোটি টাকা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলো দেশের প্রথম ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র মেঘনায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকার, ৩০ জেলে আটক চাটখিলে সরকারি সহায়তা পেল ৭১ পরিবার সুবর্ণচরে বিস্ফোরক মামলায় যুবদল নেতা কারাগারে হাতিয়ায় ৯ মণ সামুদ্রিক মাছসহ ৩০ জেলে আটক রান্না করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো গৃহবধূর ফেনসিডিল মামলায় যুবকের ৮ বছরের কারাদণ্ড ল্যাব ফাউন্ডেশন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা শাখার কমিটি নাঙ্গলকোটে সুইপারের লাশ উদ্ধার কুবিতে শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিমানে জঙ্গলে ১৭ বছর মুক্তিযুদ্ধে ভিপি শাহআলমের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে
  • শুক্রবার ০২ জুন ২০২৩ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১৮ ১৪৩০

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৪

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বপদকের ৫০ বছর

নোয়াখালী সমাচার

প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২৩  

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্মাননা পাওয়ার দিন আজ। সেটিও এসেছিল স্বাধীনতা এনে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। ১৯৭৩ সালের এই দিনে তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয় জুলিও কুরি পদক। স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে তার নামটি ঘোষণা হয়। শান্তি পরিষদের ঐ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের মে মাসে এশিয়ান পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশ্বশান্তি পরিষদের ঢাকায় হয় দুই দিনের সম্মেলন। এ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বসে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল মিলনমেলা। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে পদকটি পরিয়ে দেন বিশ্বশান্তি পরিষদের তত্কালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র। আড়ম্বরপূর্ণ ঐ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে পদক পরিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’

সদ্য স্বাধীন দেশের এই রাষ্ট্রনায়কের পদকগ্রহণ সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির ১৪০টি দেশের প্রায় ২০০ সদস্য। উপস্থিত হয়েছিলেন আপসো, পিএলও, এএমসি সোয়াপোসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও। বঙ্গবন্ধুকে ঐ পদকে ভূষিত করার বিবেচনা ও মানদণ্ড ছিল তার গোটা জীবনের দর্শন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কত্বের প্রেক্ষাপট।

জুলিও কুরি পদকের নামকরণ বেশ ইন্টারেস্টিং। বাংলায় ‘জুলিও কুরি’ নামে ডাকা পদকটির ফরাসি উচ্চারণ ‘জোলিও কুরি’। এই নামকরণ ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও কুরির নামে। ১৯৫৮ সালে তার মৃত্যুর পর বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫৯ সাল থেকে তাদের শান্তি পদকের নাম রাখে ‘জোলিও কুরি’। ফ্রেডেরিকের মূল নাম ছিল জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও। স্ত্রী ইরেন কুরিও বিজ্ঞানী। বিয়ের পর ফ্রেডেরিক ও ইরেন উভয়ে উভয়ের পদবি গ্রহণ করেন। এক জনের নাম হয় জঁ ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি এবং অন্যজনের ইরেন জোলিও কুরি। পরে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারও পান তারা। রেডিওলজির ওপর উইলিয়াম রঞ্জেনের আবিষ্কারের পথ ধরে কুরি দম্পতি তাদের গবেষণা চালিয়ে যান এবং পলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মৌল উদ্ভাবন করেন। তাদের উদ্ভাবন পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে দিয়ে গেছে।

শান্তির সংগ্রামে তাদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে পদকটির প্রবর্তন করে। আর পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত মনোনীত করা হয় সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধিতা এবং মানবতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের। ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি দম্পতির জীবনও বৈচিত্র্যময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি শুধু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেননি, গেরিলা বাহিনীতেও যোগ দেন, তাদের জন্য হাতিয়ারও তৈরি করেন। তার অবদানের সুবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান  সহজ হয়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধটির পরিসমাপ্তি ছিল জরুরি। তিনি নিজে বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতিও ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে এই পুরস্কারে ভূষিত করার পেছনে তার শান্তি কামনার বটমলাইন ধরা হয়েছে ছাত্রাবস্থা থেকেই। পরে রাজনীতির মাঠেও ছিল অহিংস তথা শান্তির মাধ্যমে সামনে এগোনোর একেকটি ঘটনা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ঐ বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অব দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস’। সম্মেলনে যোগদানের সুযোগে চীনে ৪০টির মতো দেশের শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তার নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে অভিভূত হন তারা। এর বছর চারেক পর ১৯৫৬ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলনেও অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। শান্তি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’

শান্তি-মানবতার জন্য সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা শেখ মুজিবুর রহমান তার গোটা জীবনে অবিরাম অশান্তি দেখেছেন, সয়েছেন। এক দেশের পূর্বভাগে স্বদেশে দেখেছেন পাকিস্তানিদের শোষণ-নির্যাতন, হত্যা, অশান্তি।  সেই সঙ্গে শিকার হয়েছেন সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের। বিশ্ব পরাশক্তির একাংশের অমানবিকতায় ভুগেছেন। জীবন বাজী রেখে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়া স্বাধীন দেশেও শান্তির দেখা পেলেন না তিনি। উপরন্তু, এই শান্তিকামীর সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন হয় রক্তাক্ত আগস্ট ট্র্যাজেডিতে। কাকতালীয় হোক আর ঘটনার পরম্পরায় হোক, জীবদ্দশাতেই স্পষ্ট উচ্চারণে বিশ্বকে জানিয়ে গিয়েছিলেন—পৃথিবী শোষক আর শোষিত দুই ভাগে বিভক্ত, তিনি শোষিতের পক্ষে।

ছোট্ট এক বাক্যে শত-হাজারো কথা! নিজের জীবনে একটি বিশ্বযুদ্ধ (দ্বিতীয়) দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। এর প্রতিক্রিয়াও প্রত্যক্ষ করেছেন। সে সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ ও অনাহারীদের কাছে ছুটে গেছেন খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে। তখনই বলেছিলেন, আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণে ব্যয় হোক। যুদ্ধবাজ দেশগুলোর প্রতি বঙ্গবন্ধুর সেই কথার প্রতিধ্বনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠেও। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিশ্বে অস্থিরতায় উষ্মা প্রকাশ করে তিনিও বলে চলছেন শান্তি-সহাবস্থানের কথা। যুদ্ধবাজিতে ব্যয় করা অর্থ জনকল্যাণে খরচ করার আহ্বান জানাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে বলে দরদি অনুভূতি তারও।

বিশ্বরাজনীতিতে তখন চলছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্লকের মোড়লিপনার লড়াই। ছিল সামরিক জোটও। বিশ্বশান্তি কামনার প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে কোনো সামরিক জোটে নেননি। তার স্পষ্ট কথা ছিল, আমরা সব ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সব শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী। বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব প্রত্যাশী। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’ মন্ত্র তিনি সংযোজন করে যান আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেও। তাই বলে নিরপেক্ষতার নামে নির্লিপ্ত থাকেননি।

বিশ্বের যেই প্রান্তের যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, অশান্তি ভর করেছে—এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দিয়েছেন শান্তির বার্তা। তত্কালীন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনিসহ দুনিয়ার সব উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহত্ প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করে ক্ষোভ জানিয়েছেন অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইলের জোরপূর্বক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সব বর্ণভেদবাদী নীতির। বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বার্তাগুলো আজও কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, শান্তি-সম্প্রীতির বীজমন্ত্র।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে এই শান্তি পদক প্রদানের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র দেশ সেই সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দরিদ্র দেশের সরকারপ্রধানকে ঐ সময় এমন বৈশ্বিক শান্তি পদক প্রদান ছিল ঐ সময়ের অন্যতম আন্তর্জাতিক সংবাদ। আজকের বিশ্বের জন্য তা কেবল স্মরণের নয়; ভাবনা ও বিশ্লেষণেরও, যেখানে রয়েছে শিক্ষা নেওয়ার অনেক উপাদানও।  

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন