ব্রেকিং:
কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন মামুনুল হক শেখ হাসিনার কালো খাতায় নাম লেখালে কী হয়? সরাসরি মুসলিমদের নিশানা বানিয়ে ভোটের প্রচারে মোদি দেশে পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনো দিন হবে না এটা আমার শেষ বিসিএস ছিল, ৩-৪ মিনিটের জন্য স্বপ্ন ভেঙে গেল এক সপ্তাহে রেকর্ড সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি এসটিপি ছাড়া নতুন ভবনের অনুমোদন দেওয়া হবে না : গণপূর্তমন্ত্রী সাড়ে ৫৮ লাখ টাকার হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ জব্দ পুকুর থেকে মাদরাসা ছাত্রীর লাশ উদ্ধার বাংলাদেশি জিনাতের সোনা জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বক্সিংয়ে নিয়মিত দ্বিগুন মাত্রার শব্দে দূষণের শিকার কুমিল্লা নগরী দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধ-র্ষ-ণে-র অভিযোগ দেশের যত অপরাধ তার সবই করে বিএনপি: প্রধানমন্ত্রী শিশু সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যা বিশেষ কায়দায় ৪০ কেজি গাঁজা পাচার দুদিনব্যাপী পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রশিক্ষণ ৪ মে থেকে বাড়ছে ট্রেনের ভাড়া মেট্রোরেলের আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের উদ্বোধন ৪ নভেম্বর দুর্গাপূজা: দেশজুড়ে মণ্ডপের নিরাপত্তায় ২ লক্ষাধিক আনসার-ভিডিপি ১৫ বছরে ধানের ৮০ নতুন জাত
  • শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২০ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুসলমানরাই বাংলাদেশের আদিবাসী

নোয়াখালী সমাচার

প্রকাশিত: ৮ আগস্ট ২০২০  

শিরোনাম দেখে যে কেউ অবাক হতে পারেন। আর অবাক হবারই কথা। পার্বত্য এলাকার উপজাতিদের যখন সাংবিধানিকভাবে আদিবাসী প্রতিষ্ঠা করার তোড়জোর চলছে তখন এই নিবন্ধ সম্পর্কে অনেকের মনেই খটকা লাগতে পারে। আর কৌতূহল জাগাই স্বাভাবিক। পশ্চিমারা অনেক আগ থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে দেশের সেক্যুলার-বাম রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। বিশেষ করে প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসকে সামনের রেখে এদের মাতামাতি যেন অনেকটাই বেড়ে যায়। এই প্রবন্ধ তাদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

দক্ষিণ বাংলার ইতিহাস গবেষক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ লিখেছেন, ‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ বাঙালি জাতির প্রধান আদি বাসস্থান। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বাঙ জাতি এ অঞ্চলে বাস করত।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘প্রাচীন জনপদগুলো জনগোষ্ঠীর নামানুসারে নামকরণ হয়েছে। বাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর নামকরণও বাঙ, কৌম বা গোত্র থেকে হয়েছে। ভাগিরথীর পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙ জনগোষ্ঠী বাস করত। … তাদের নামানুসারে বঙ্গ জনপদের নাম।’ আদিমযুগ থেকেই স্থান বা জাতির নামকরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষ প্রাধান্য পায়। আধুনিক যুগেও এ প্রথা বিদ্যমান। যেমন বুদ্ধের অনুসারীরা বৌদ্ধ, যীশুখ্রিস্টের অনুসারীরা ক্রিশ্চিয়ান বা খ্রিস্টান, কার্ল মার্কসের অনুসারীরা মার্কসবাদী প্রভৃতি। আবার শ্রীলঙ্কার আদম চূড়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, ভারতের মম তাজমহল ইত্যাদি।

উল্লেখ্য পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথম পদার্পণ করেছিলেন সিংহলে। এটি তখন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে স্থানটি শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কার আদম চূড়া বা অ্যাডাম পিক্ এখনও হযরত আদম (আ.) এর স্মৃতি, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিকতা বহন করে চলেছে। পাহাড়টি শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের শ্রিপাডা নামক প্রদেশে অবস্থিত। এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিকট একটি আকর্ষণীয় স্থান। মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান-এই চার ধর্মের অনুসারীদের কাছে পাহাড়টি অতি পবিত্র স্থান। চূড়াটির উচ্চতা ৭৩৬২ ফুট। চূড়ায় হযরত আদম (আ.) এর পায়ের যে চিহ্ন রয়েছে তার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং চওড়া হচ্ছে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি। তাছাড়া আদি মানব আদম (আ.) এর পুত্র হযরত শিষ (আ.) এর কর্মক্ষেত্রও ছিল ভারতে। ভারতের অযোধ্যায় এক মন্দিরের পাশে সুদীর্ঘ কবর আছে। ওই সমাধি হযরত শিষ (আ.) এর বলে কেউ কেউ মনে করেন। তাই বলা যায়, মুসলমানরা শুধু আরব দুনিয়া কিংবা বাংলাদেশের আদিম নিবাসী নয়; গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেরই ভূমিপুত্র।

ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের মত অনুযায়ী পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.)। তিনি মানবজাতির আদি পিতা এবং ইসলামের প্রথম নবী। বিষয়টি এখন আর শুধু ধর্মীয় উপকথা নয়। ঐতিহাসিকভাবে সত্য। পরবর্তীতে হযরত নূহ (আ.) এর সময় সংঘটিত প্লাবনে তার অনুসারী ৮০-৮৫ জন নাগরিক ব্যতিত সবাই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্লাবনের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশও এ বন্যা হতে বাদ যায়নি। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, আক্রা এবং বদ্বীপ অঞ্চলের অন্যত্র মাটির নিচে বড় বড় প্রস্তর ও উপলখ-ের এক বিরাট স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। এ প্লাবনের সঙ্গে তার যোগ আছে। ঘূর্র্ণিঝড় হতে রক্ষাপ্রাপ্ত নৌকারোহীদের সবাই ছিলেন আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত মুসলমান। ইসলামের অনুসারী এই কয়েকজন ব্যক্তিই বর্তমান বিশ্ব মানবগোষ্ঠির পূর্ব পুরুষ। তাদের থেকেই সৃষ্ট বর্তমান পৃথিবীর সাতশ’ কোটি নর-নারী। আল কোরআন ও বাইবেলের বক্তব্যও একই সূত্রে গ্রন্থিত। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হান্নান লিখেছেন, “হযরত আদম (আ.) থেকে আমাদের এই মানব জাতির শুরু। কিন্তু হযরত নূহ (আ.)-এর সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন ঘটেছিল। এই মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সকল কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেউ জীবিত ছিল না, শুধু নূহ (আ.)-এর নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নূহের ভক্ত; এই ৮০ জন থেকেই মানব জাতির আবার নতুন যাত্রা।

“এই নতুন যাত্রায় জাতিরও সম্পর্ক ছিল। বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে ছিলেন হযরত নূহের এক পুত্র; নাম তার ‘হাম’। নূহ তার পুত্র হামকে বললেন, ‘তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্যে চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে’। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। সেখানে এসে তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতের দিকে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নাম অনুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান।
“হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। এই ‘বঙ্গ’-এর সন্তানরাই বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করে। এই গল্প সত্যি হলে বলতে হবে বাঙালির আদি পুরুষ হচ্ছেন ‘বঙ্গ’।”

অষ্টাদশ শতাব্দির ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলীম লিখেছেন, ‘হযরত নূহ (আ.) এর পুত্র হামের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুণ এই অঞ্চলের নাম তার নামানুসারে রাখা হয়। সিন্ধু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সাথে এসে সিন্ধু দেশে বসতি স্থাপন করায় এই অঞ্চলের নাম তারই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বং (বঙ্গ)-এর সন্তানেরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিলো বং।’ শেখ আবুল ফজল আলামি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের মন্ত্রী, সভাসদ এবং নবরত্নের একজন। আবুল ফজল বাঙ্গাল ও বাঙ্গালাহ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাঙ্গালাহ’র আদি নাম ছিলো ‘বঙ্গ’। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্রকা- ‘আল’ নির্মাণ করতেন। এ থেকেই ‘বাঙ্গাল’ এবং ‘বাঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি।’ কিন্তু ‘আল’ কে বাংলা বা সংস্কৃত ভাষার শব্দ বা বর্ণ সমষ্টি বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ-ভারতে শব্দটির ব্যাপক ব্যবহারও দেখা যায় না। ‘আল’ সেমেটিক বা আরবি ভাষা থেকে উদ্ভুত। সেমেটিক ভাষায় ‘আল’ অর্থ আওলাদ, সন্তান-সন্তুতি ও বংশধর। এ অর্থে (বং+আল) বঙাল বা বঙ্গাল (অর্থাৎ বং-এর বংশধর) শব্দের উৎপত্তি হতে পারে। এখনও গ্রামে-গঞ্জে বংশ বা প্রজন্ম বুঝাতে আহ্ল বা আল শব্দ বুঝানো হয়। তাই বলা যায় হযরত নূহ (আ.) প্রোপৌত্র বং-ই হলো প্রথম বাঙালি এবং বাংলাদেশের প্রথম মানুষ। এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ হান্নান এর বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য।

তিনি লিখেছেন, ‘… বাঙালির প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের প্রাপ্ত নিদর্শনের সময়কালের সাথে নূহ (আ.)-এর পৌত্র এবং প্রপৌত্রদের আগমনের সময়পর্বকে ড. মরিস বুকাইলির অনুমানের সাথে মেলানো সম্ভব। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি কম করে হলেও দশ হাজার বছরের প্রাচীন এবং বাংলাদেশের সভ্যতা ও বাঙালি জনমানুষের বসতি এই সময়পর্বেরই ধারাবাহী। এ কথা অনুমান করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়।’ আর তার ধর্মীয় পরিচয় ছিল ইসলাম। তাই মুসলমানরাই বাংলাদেশের আদিবাসী এবং আদিম নাগরিক। আর আদিম বা আদি শব্দ দুটির উৎপত্তিও ‘আদম’ থেকে হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। এদেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, উপজাতিসহ সকল সম্প্রদায়ই এ শব্দটি নিশঙ্কচিত্তে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লেখ্য এবং কথ্য উভয় ভাষাতেই ব্যবহার করে। অন্যদিকে জনসংখ্যা গণনা ও পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে ‘আদমশুমারি’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। এক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য।

ওপরে উল্লিখিত ‘বং’ জাতির পরবর্তী জনগোষ্ঠীই হয়ত অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অস্ট্রিক বা নিষাদ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ‘কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এদেরকেই বাংলাদেশের আদিম মানবগোষ্ঠী আখ্যা দিয়েছেন’। এখন প্রশ্ন হলো বং জাতি মুসলিম হলে পরবর্তী অস্ট্রিক-নিষাদ-দ্রাবিড়দের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে ধারণা নেয়ার সুযোগ কোথায়? এ কথা সত্য সময়ের বিবর্তনে মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শ গ্রহণ করে। যুগে যুগে মানুষ ও রাষ্ট্র প্রণীত নানা মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে দুনিয়ার বুকে। কালক্রমে এদেশে বিভিন্ন ধর্মাদর্শ ও মতবাদ প্রবর্তিত হয়। এখানের বং জাতিও তাওহীদবাদী ধর্ম পরিত্যাগ করে একসময় ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসে আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের মৌলিক জাতিসত্তাও বদলে যায়। মুর্তিপূজা, জড় পূজা, সূর্য পূজা, প্রতীক পূজা, প্রকৃতি পূজা তাদেরকে গ্রাস করে। ফলে স্বভাবতই তারা মূল ধর্মবিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়ে মানব রচিত মতবাদ গ্রহণ করে। তাই মুসলমানরাই যে বাংলাদেশের প্রাচীন বাসিন্দা সেক্ষেত্রে পরবর্তী ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।

অন্যদিকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক দ্রাবিড় জাতিকে বাঙালির আদি মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ‘আর্যোপনিবেশের পূর্বে যে প্রাচীন জাতি ভূমধ্যসাগর হতে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত স্বীয় অধিকার বিস্তার করেছিল তাহারাই বোধ হয় ঋগ্বেদের দস্যু এবং তাহারাই ঐতরেয় আরণ্যকে বিজেতৃগণ কর্তৃক পক্ষী নামে অভিহিত হইয়াছে। এই প্রাচীন জাতিই বংগ মগধের আদিম অধিবাসী।’ ভারতবর্ষে দ্রাবিড়দের আগমন ঘটেছে সুপ্রাচীনকালে, প্রাগৈতিহাসিককালে এবং তারা এসেছে সেমেটিকদের আদি আবাসভূমি পশ্চিম এশিয়া থেকে। অর্থাৎ ব্যাবিলন বা মেসোপটেমিয়াই ছিলো দ্রাবিড়দের উৎপত্তিস্থল। সেমেটিক সভ্যতার উৎস সামের প্রোপৌত্র এবং হযরত নূহ (আ.)-এর সপ্তম অধস্তন বংশধর আবু ফীর ছিলেন উপমহাদেশের দ্রাবিড়দের আদি পুরুষ। অতএব, দেখা যায় দ্রাবিড়রা ছিল অহিভিত্তিক ধর্ম ইসলামের অনুসারী। এই তৌহিদী আদর্শের কারণেই আর্য হিন্দুদের সাথে তাদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়, তার অধিকাংশই ঘটে ধর্ম ও আদর্শিক কারণে। যেমন: ইব্রাহীম-নমরুদের দ্বন্দ্ব, ফিরআউন-মুসার সংঘর্ষ, আর্য-অনার্য সংঘাত, মহানবী (সা.) ও মুশরিক-ইহুদিদের সংঘাত, তারিক-রডারিক সংঘর্ষ, ঘুরী-পৃথ্বিরাজ যুদ্ধ, ঐতিহাসিক ক্রুসেড, হিটলারের ইহুদি নিধন, রাশিয়ায় ধর্মের মূলোৎপাটন কিংবা উইলিয়াম বুশের ইরাক-আফগানিস্তান অভিযান সবই আদর্শিক সংগ্রাম। আর্য হিন্দু-দ্রাবিড় সহস্র বছরব্যাপী যে বিরোধ চলছিলো সেটা শুধু ঔপনিবেশিক তৎপরতা ছিল না; বরং তার মূলে ছিল ধর্ম-রাজনীতি-আদর্শ-নৈতিকতা। তাই দেখা যায় দ্রাবিড়রাও যদি এদেশের প্রাচীন অধিবাসী হয় তাহলেও বলা যায় মুসলিমরাই বাংলাদেশের ভূমিপুত্র।

ভৌগোলিক দিক বিশ্লেষণ করলেও দেখা যাবে মুসলমানরাই বাংলাদেশের আদিম অধিবাসী। ‘দশ কুমার চরিত’ হিন্দু ধর্ম সম্পর্কিত একটি প্রাচীন গ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সে সম্পর্কে শ্রী অক্ষয় কুমার দত্ত লিখেছেন, ‘দশ কুমার চরিতের প্রথম ও চতুর্থ উচ্ছ্বাসে কাল যবন-দ্বীপ এবং ষষ্ঠ-উচ্ছ্বাসে যবন ও যবন পোতের প্রসঙ্গ আছে। এইচ এইচ উইলসন ওই যবন জাতি, যবন-পোতকে আরব জাতি ও আরব পোত বলিয়া বিবেচনা করিয়াছেন।’ অতএব বাংলাদেশের সাথে আরব, অ্যারাবিয়ান সংস্কৃতি ভাষার যোগসূত্র বিদ্যমান। অতীতকাল থেকেই আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের সহজপথ সামুদ্রিক পানিপথ। ‘প্রতিটি উল্লেখযোগ্য সামুদ্রিক বন্দরেই আরবি ভাষা বুঝত ও বলত’। অর্থাৎ পৃথিবীর বড় বড় সামুদ্রিক বন্দর ও পানিপথগুলোতে আরব ও সেমেটিকদের আধিপত্য ছিল। বাংলাদেশ হলো একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। এখানে এ সত্যটি অধিক প্রযোজ্য। আরবরাই পৃথিবীতে প্রথম সভ্যতার আলো ছড়ায়। তারাই প্রথম লিপি বা বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছেন। দক্ষিণ আরব বা ইয়েমেন ও ব্যাবিলন ছিল সভ্যতার আদি উৎসভূমি। পৃথিবীতে সকল দেশের সভ্যতা একই সময়ে একই সাথে সৃষ্টি হয়নি।

সেমেটিক বা ইসলাম অনুসারী আদিযুগের মানুষেরাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে নতুন নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়। তাই প্রাচীন বাংলাদেশও মুসলমানদেরই সৃষ্টি। আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাংলাদেশের অধিবাসীদের দস্যু, ম্লেচ্ছ ও অসুর বলতো। ভিন্ন ধর্মমতের কারণেই তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে এরূপ আক্রোশ ও বিদ্বেষভাব পোষণ করতো বলে আমরা মনে করি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ. এল, বালাম আর্যদের ওপর গবেষণা করে তার বিবরণীতে লিখেছেন, ‘আর্যরা নিরক্ষর ও বর্বর। নাগরিক সভ্যতার সাথে তাদের কোনো পরিচয় ছিল না। তারা যাযাবর জীবন-যাপন করতো এবং তাদের গোত্রপতির নেতৃত্বে হানাহানিতে লিপ্ত থাকত। রাষ্ট্রীয় ধারণা তাদের মাঝে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল।’ রাজা গশতাসাপ-এর আমলে ইরানে ধর্ম নিয়ে মতবিরোধ, আত্মকলহ ও পরিণামে ভীষণ যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়। যরদাশত বা যরথ্রুষ্ট সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে ইসলামের বাণী প্রচার করেন। বাদশাহ গশতাসপ তার সভাসদসহ এ ধর্মমত গ্রহণ করেন। কিন্তু কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে মগ্ন আর্য হিন্দু প-িত-পুরোহিতের দল পিতৃপুরুষের ধর্মের দোহাই দিয়ে জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে নবদীক্ষিত মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়। ফলে পৈতৃক ধর্ম ও শিরকবাদী সংস্কৃতি নিয়ে যাযাবর আর্যরা বিদ্রোহী মুশরিকদের নিয়ে হিন্দুস্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে আসে। ভারতে এসেই তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোসহ প্রাচীন সমৃদ্ধশালী সভ্যতাগুলো ধ্বংস করে। ইরানের ব্যর্থতা এখানে তারা সুদে-আসলে আদায় করে। ইসলাম ধর্ম বিকাশের কারণেই তাদেরকে ইরান ত্যাগ করতে হয়। প্রতিশোধ গ্রহণ করে ভারতে এসে। তাতে ধারণা করা যায় ইরান ও ভারতের দুই সম্প্রদায়ই একই ধর্মবিশ্বাসের (ইসলাম) অন্তর্ভুক্ত ছিল।

হিন্দুরা ভারত ভূমির আদিম নিবাসী ছিলেন না; দেশান্তর হতে আগমন করে এ স্থানে অবস্থিত হয়েছেন। প্রাচীনতার দিক থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ এদেশে অপেক্ষাকৃত নতুন সম্প্রদায়। হিন্দুদের আদি নিবাস নিয়ে পণ্ডিতগণ একমত হতে পারেননি। কেউ বলেছেন তুর্কিস্তান বা রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল, কারও মতে ইরান, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী বা বোহেমিয়া। তবে অধিকাংশের মতে দক্ষিণ রাশিয়া। এরা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে এ উপমহাদেশের আগমন করেন। তাদের আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ফলে দ্রাবিড় অধ্যুষিত সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়। এরপর তারা পাঞ্জাবের পঞ্চনদ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন।

প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদের আর্যহিন্দুদের ভারতে আগমন সম্পর্কিত তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে। ‘বৈদিক যুগের মানুষ ভারতে এসেছিল বাহির হতে এবং তারাও প্রাগৈতিহাসিক যুগের অন্তর্ভুক্ত’। এখন প্রশ্ন হলো এই আদিম জাতির বাসভূমি কোথায় ছিল। এই নিয়ে প্রচুর মতদ্বৈত আছে। জার্মান পণ্ডিত কোসিনা প্রতিপাদিত করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, তাদের আদি বাসভূমি ছিল উত্তর ইউরোপিয় উপত্যকায়। ভারতীয় গবেষক বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, প্রাচীন আর্য জাতির বাস ছিল ৬০০০ খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দিতে উত্তর মেরু অঞ্চলে। … অধ্যাপক জে. এল. মায়ার্স, হ্যারল্ড পিক এবং চাইল্ড মনে করেন, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দিতে এদের নিবাস ছিল দক্ষিণ রাশিয়াতে এবং তার পূর্বাঞ্চল কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। …পিগোটের ধারণায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দির পরবর্তী শতাব্দিগুলোতে উত্তর পশ্চিম থেকে ভারত একাধিক জাতি কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। ভারত-ইউরোপিয় ভাষাভাষী মানুষও তাদের অন্যতম ছিল। …হুইলারের ধারণা এই সময়ই ঋগে¦দ বর্ণিত প্রাচীন আর্যজাতি উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে এবং হরপ্পা সংস্কৃতির ধারক যে মনুষ্যগোষ্ঠী ছিল তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দির গোড়ার দিকে ভারতে হরপ্পা সংস্কৃতি পূর্ণ মহিমায় অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের সংস্কৃতি নগরকেন্দ্রীক এবং সেই নগরগুলো দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। আর্যজাতি ভারতে প্রবেশ করলে তাদের (ভারতবাসির সাথে) সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাদের দুর্গগুলো ধ্বংস করে দেয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনারই ছায়াপাত হয়েছে ঋগ্বেদের ইন্দ্রের বীরত্বসূচক কীর্তির বর্ণনায়। উল্লেখ্য দেবরাজ ইন্দ্র পঞ্চাশ সহস্র কৃষ্ণবর্ণ শত্রুকে (ভারতীয়কে) বিনাশ করেছিলেন এবং শম্বরের নগরসমূহ ধ্বংস করেছিলেন। ইন্দ্র শম্বরের ৯৯টি পুরী (শহর) ধ্বংস করেছিলেন এবং দিবোদাসকে শততম পুরী বাসের জন্য দিয়েছিলেন।

তবে বাংলাদেশে তাদের অভিযান পরিচালিত হয় হয় খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দিতে। এতে বোঝা যায়, এ উপমহাদেশে হিন্দু আক্রমণ ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পর দু’হাজার বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্যদের প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়নি। এরপূর্ব থেকেই বৌদ্ধধর্মের কিছুটা প্রভাব ছিল বাঙালি সমাজে। পরবর্তীতে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা পালাক্রমে প্রায় সাতশত বছর রাজত্ব করেন। কিন্তু জনসাধারণ তাদের ধর্মমতকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসন কায়েম হলে সাধারণ মানুষ স্বতর্স্ফূতভাবে ইসলামকে মেনে নেয়। ‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে এখানকার মানুষ প্রচলিত কোনো ধর্মেরই অনুসারী ছিল না। তারা হয়তো সর্বপ্রাণেশ্বরবাদ জাতীয় কোনো কোনো ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল; কিংবা ধর্মীয় রীতি-নীতির সাথে সেভাবে পরিচিতও ছিল না। মুসলমানদের আগমনের আগে এই অঞ্চলে হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসকদের শাসন জারি ছিল। এসব শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় উল্লিখিত ধর্মসমূহের উপাসনাগৃহও নির্মিত হয়েছে। অনেক শাসক তাদের ধর্মমত প্রচারের জন্য নানা কর্মসূচিও গ্রহণ করেছিল। কিন্তু নানা কারণে তা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বা পৌঁছায়নি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম, কামরূপ প্রভৃতি এলাকায়ও হিন্দুরা এবং বার্মায় বৌদ্ধধর্ম বিকশিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলটিতে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম বা কোনো ধর্মই মানুষের কাছে পৌঁছেনি। ফলে গ্রন্থভিত্তিক ধর্মের গণ্ডির বাইরে থেকে যায় এখানকার মানুষ’।

এদেশে খ্রিস্টানদের বয়স চারশত বছরের মতো। পর্তুগিজ নাবিক ও জলদস্যু ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ সালে ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছে। পরে ইটালিয়ান, স্পেনিশ, ফরাসি, ওলন্দাজ খ্রিস্টানরাও ভাগ্যান্বেষণে এদেশে আসে। ১৬০০ সালের ২৪ আগস্ট আসেন বৃটিশ খ্রিস্টান উইলিয়াম হকিন্স। সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে ব্যবসার অনুমতি চাইলে সম্রাট মঞ্জুর করেন। সর্বশেষ ১৭৫৭ সালে পলাশি ট্রাজেডির মাধ্যমে খ্রিস্টানরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে। পর্যায়ক্রমে দখলে নেয় সমগ্র ভারতবর্ষ। ইংরেজ-হিন্দু সখ্যতা এবং তাদের যৌথ মুসলিম বিরোধিতার কারণেই এই বিশাল পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল।

বাংলাদেশ ভূমিতে সর্বশেষ আগমন ঘটে পার্বত্য উপজাতিদের। অথচ কী আশ্চর্য! তাদেরকেই নাকি আদিবাসী ঘোষণা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামই বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল, যেখানকার মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অবাঙালি এবং অমুসলিম। অঞ্চলটি একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, নানা ভাষাভাষী এবং নানা ধর্মাবলম্বীসহ বহু সংস্কৃতিবিশিষ্ট জনসংখ্যার একটি এলাকা। নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে একথা এখন সুস্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী কোনো জনগোষ্ঠীই এখানকার কোনো আদিবাসী বা ভূমিপুত্রের দাবিদার হতে পারে না। উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মারমারা দ্বিতীয় অবস্থানে। চাকমারা ১৫০ থেকে ৩০০ বছর পূর্বে মুঘল আমলের শেষ থেকে ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে মিয়ানমার থেকে পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করে। বোমরা চীন পর্বত থেকে এখানে আগমন করে। খ্যাং, পাংখো এবং কুকিরা ২০০ থেকে ৫০০ বছর আগে এখানে স্থানান্তরিত হয়ে আগমন করে।

ভারতীয় গবেষক বিজি বারগিজ তার ‘নর্থ ইস্ট রিসারজেন্ট’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয়রা হচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারীদের মতো তিব্বতি/বার্মা/মন খেমার বংশোদ্ভূত। এসব উপজাতি ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যে এ এলাকায় অভিবাসন করে। বিভিন্ন স্থান থেকে আসায় তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষা আলাদা’।

ধর্ম ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে জনসংখ্যাকে পাঁচটি শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং উপজাতি। উপজাতিদের মধ্যে আবার নানা ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। বর্ণিত পাঁচ সম্প্রদায়ের মধ্যে শেষোক্ত চার সম্প্রদায় বাংলাদেশে বসতি গড়ে অনেক পরে। এদেশ আবাদ করে প্রথম মুসলিমরাই। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে মুসলমানদের নাড়ির সম্পর্ক। এজন্যই বার শতকে সেন শাসক ও ব্রাহ্মণরা মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে নির্মূল করার জন্য হুকুম জারি করেছিল। ভাষাবিজ্ঞানী ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বাংলা ভাষায় তাদের ধর্মচর্চাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছিল। অষ্টাদশ পুরানাম রামশ্য চরিতানেচ ভাষায়ং মানবাশ্রু তা রৌরবং নরকং ব্রজেত। অর্থাৎ মানব রচিত বাংলা ভাষায় যে অষ্টাদশ পুরাণ এবং রামচর্চা করবে তার ঠাঁই হবে রৌরব নরকে।

সংস্কৃত ভাষাকে দেবভাষা আখ্যায়িত করে এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সর্বকৌশল প্রয়োগ করেছিল। বাংলার সঙ্গে তাদের বিরোধের কারণ হচ্ছে, বাংলা ভাষায় একটি মুসলমানী ঢং সুদূর অতীতকাল থেকেই ছিল। বাঙালিত্বের সাথে সরাসরি সম্পর্ক একত্ববাদ তথা ইসলামের মর্মবাণীর। তাই ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমানরা বাঙালি। বাঙালিরাই মুসলিম। মুসলমানরাই বাংলার আদিম নিবাসী। বাংলাদেশের মূল ভূমিপুত্র মুসলিমরা। তাই সাংবিধানিকভাবে উপজাতি নয় মুসলমানদেরকেই আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক।

প্রাগৈতিহাসিককালে একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা দ্বিনের অস্তিত্ব ছিলো না। মহান আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামিন হযরত আদম (আ.) কে ইসলামি দ্বীন দিয়েই দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। আর প্রাচীন ধর্ম ইহুদিবাদ সৃষ্টি হয় আরও অনেক পরে। অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্মের বয়স মাত্র দু’হাজার বছর। হযরত ইসা (আ.) বা যিশুখ্রিস্ট প্রথম শতাব্দিতে বেথেলহেমে জন্মগ্রহণ করেন। ইহুদি জাতি বা হিব্রুদের আদি নেতার নাম আব্রাহাম বা হযরত ইবরহিম (আ.)। তার আবির্ভাবকাল সম্পর্কে যে ধারণা ইতিহাসবিদরা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ বা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়ার পশুপালক সম্প্রদায়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর সাথে হযরত ইবরহিম (আ.)- এর নাম জড়িয়ে আছে। তার ছেলে হযরত ইসহাক (আ.)-এর বংশেই জন্ম নিয়েছিলেন ‘ইহুদিধর্মের প্রবর্তক’ (ইহুদিদের মতে) হিসেবে খ্যাত হযরত মুসা (আ.) এবং ‘খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক’ (খ্রিস্টানদের মতে) হিসেবে খ্যাত হযরত ইসা (আ.)। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে হযরত মুসা (আ.) হিব্রু জাতিতে আবির্ভূত হন। তাই দেখা যায়, মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দুনিয়াতে মানুষের সূচনাকালে তাদের জীবনদর্শন হিসেবে ছিল একমাত্র ইসলাম।

অন্যসব ধর্ম পরবর্তী সময়ে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মানুষ নিজেরাই সৃষ্টি করে। আর সভ্যতার শুরু থেকেই বাংলাদেশে মানবজাতির বসবাস ছিল। ওই সময়ের একমাত্র ধর্ম হিসেব তাদের জীবনাদর্শ ইসলাম বৈ অন্য কিছু হতে পারে না।

আল কোরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ সকল প্রকারের প্রাণীকে পয়দা করেছেন পানি হতে’ (২৪:৪৫)। অন্যত্র বলা হয়েছে ‘অবিশ্বাসীরা কী ভেবে দেখে না যে, আকাশম-লী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিল? পরে আমি তাদের পৃথক করেছি এবং আমি প্রতিটি জীবন্ত জিনিসকে বের করেছি পানি হতে? তারপরও কী তারা বিশ্বাস করবে না?’ (২১:৩০)।

ওপরের কোরআনের আয়াতের অনুবাদে যেখানে ‘পানি’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে তার মূল আরবি হচ্ছে ‘মা’। এর দ্বারা যেমন আসমানের পানি বুঝায়, তেমনি বুঝায় সমুদ্রের পানিও। শুধু তাই নয়, এই ‘মা’ শব্দের দ্বারা যেকোনো তরল পদার্থকেও বুঝানো হয়ে থাকে। সুতরাং এখানে এই ‘মা’ শব্দের দ্বারা প্রথম অর্থে যে ‘পানি’কে বুঝানো হয়েছে সে ‘পানি’ হচ্ছে জীবনের অপরিহার্য উপাদান। বিভিন্ন ভাষায় জন্মদাত্রীকে সন্তানেরা ‘মা’ নামে ডেকে থাকে। তার সূত্র বোধ হয় এখানেই নিহিত।

বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্রই জন্মদাত্রী মাতাকে ‘মা’ নামে ডাকা হয়। ‘মা’ ডাক সর্বাপেক্ষা সুমধুর। সন্তানদের প্রথম বুলি ‘মা’। ছেলে-মেয়েদের কাছে দুনিয়ায় মায়ের চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই। মায়ের উদর থেকে যেমন সকল শিশুর আবির্ভাব, তেমনি পানি থেকেই সকল সৃষ্টজীবের জন্ম। এক্ষেত্রে পানি মাতৃসমতুল্য। পানি থেকেই প্রাণীর উদ্ভব। তাই পানির আরবি প্রতিশব্দ ‘মা’ থেকে ‘মা’ ডাকের উৎপত্তি বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এদেশের যারা আদিম অধিবাসী তারাই এই ‘মা’ ডাকের প্রচলন করে। আর তারা মুসলিম সম্প্রদায় বৈ অন্য কোনো জাতি বা ধর্মের নাগরিক হতে পারে না। আর তাদের মাতৃভাষা সেমেটিক বা আরবি হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। তাই বাংলাদেশ মুসলমানদের পূণ্যভূমি, তারাই এদেশের আদিবাসী, তারাই এদেশের প্রাচীন অধিবাসী, তারাই এদেশের মাটির সন্তান, ভূমিজপুত্র।