ব্রেকিং:
ভারতের কাছে পাঁচটি খাদ্যপণ্যের নিশ্চিত সরবরাহ চায় বাংলাদেশ এপ্রিলে বাংলাদেশে আসছেন কাতারের আমির ঈদযাত্রা: পঞ্চম দিনের ট্রেন টিকিট বিক্রি শুরু প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন রাতে ঈদযাত্রায় ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু জলবায়ু সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব: রাষ্ট্রপতি ঈদে মহাসড়কে ৬ দিন বন্ধ থাকবে ট্রাক চলাচল সুইডেনের রাজকন্যা ভিক্টোরিয়াকে বরণে হাতিয়ায় চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি ‘ইফতার পার্টিতে আল্লাহর নাম না নিয়ে আওয়ামী লীগের গিবত গায়’ গাজায় হামাসের শীর্ষ কমান্ডার নিহত রাফাহতে ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে বাইডেনের আপত্তি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা অসম্ভব: প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে জয়লাভের পর পরমাণু যুদ্ধ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিলেন পুতিন বাংলাদেশকে ২০ টন খেজুর উপহার দিল সৌদি আরব জিম্মি জাহাজের ৪ জলদস্যুর ছবি প্রকাশ্যে বেতন নেবেন না পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জারদারি জলদস্যুর কবলে পড়া নাবিকদের ১১ জনই চট্টগ্রামের রাখাইনের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলের দ্বারপ্রান্তে আরাকান আর্মি কুমিল্লা সিটির প্রথম নারী মেয়র হলেন তাহসীন বাহার ভাঙারির দোকান থেকে উদ্ধার হলো ১১ মণ সরকারি বই
  • বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

বসবাসের অযোগ্য মরুভূমি থেকে কাতার যেভাবে শীর্ষ ধনী দেশ

নোয়াখালী সমাচার

প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০২১  

মধ্য প্রাচ্যের ছোট্ট একটি দেশ কাতার। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে কাতার পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ। এই দেশের প্রায় পুরোটা অঞ্চলই হলো মরুভূমি। গ্রীষ্মকালে কাতার উপদ্বীপের তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সেকারণে পৃথিবীর শীর্ষ বসবাসের অযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে কাতার অন্যতম। অতীতের এই ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল দুর্গম ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার অতি দরিদ্র একটি দেশ। ১৯৭১ সালে কাতার ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। সেসময় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে থাকা সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ছিল কাতার। কিন্তু কাতারের সেই শোচনীয় অবস্থা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

কাতারের আয়তন মাত্র সাড়ে ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের বিচারে বাংলাদেশ কাতারের চেয়ে প্রায় ১৩ গুণ বড়। কাতারের জনসংখ্যা ৩০ লাখেরও কম। এর মধ্যে মাত্র তিন লাখ লোক কাতারের নাগরিক এবং বাকি সবাই প্রবাসী। কাতারের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের ৭১ গুণ বেশি। অতীতে কাতারের অর্থনীতি ছিল মাছ ধরা এবং মুক্তা শিকারের উপর নির্ভরশীল। ১৯২০ সালে জাপানে চাষ করার মুক্তার কারণে কাতারি মুক্তাশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। তারপরও দরিদ্র এই দেশটির ভাগ্যের চাকা বদলে যায় অভাবনীয় উপায়ে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো কাতারও তার মাটির নিচের খনিজ সম্পদের কারণে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। তবে কাতার তার প্রতিবেশীদের মতো শুধু খনিজ তেলই নয়, সেই সঙ্গে পেয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি।

 

অতীতে কাতারের অর্থনীতি ছিল মাছ ধরা এবং মুক্তা শিকারের উপর নির্ভরশীল

অতীতে কাতারের অর্থনীতি ছিল মাছ ধরা এবং মুক্তা শিকারের উপর নির্ভরশীল

পৃথিবীর অন্যতম এই ক্ষুদ্র দেশে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এসব খনিজ সম্পদ থেকে লাভবান হতে কাতারের বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। ১৯৪০ সালে কাতারের সর্বপ্রথম তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। এরপর ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত দেশটির খনিজ সম্পদ বিদেশিদের দ্বারা শোষিত হতে থাকে। তখনও পর্যন্ত কাতারি জনগণের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭০ সালের শেল কোম্পানি কাতারের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি আবিষ্কার করেন। এই খনির নাম দ্য নর্থ ফিল্ড। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাসের খনি। যে সময় কাতারে এই খনি আবিষ্কার হয়েছে, সে সময়ে প্রাকৃতিক গ্যাস মোটেও লাভজনক ব্যবসা ছিল না। কারণ সে সময়ে গ্যাস শুধুমাত্র পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করার ব্যবস্থা ছিল। 

আর কাতার এমন এক দুর্গম জায়গায় অবস্থিত যে সেখান থেকে পাইপের মাধ্যমে চাহিদাসম্পন্ন কোন জায়গায় গ্যাস পৌঁছানো ছিল অনেকটাই অসম্ভব। সে কারণে এত বিপুল সম্পদ থাকার পরও ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাতারের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। কাতারের আল থানী রাজপরিবার দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাতার শাসন করে আসছেন। কাতার শীর্ষ ধনী দেশ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে সাবেক আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানী। তিনি ১৯৯৫ সালে তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কাতারের রাজক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। হামাদ বিন খলিফার মূল লক্ষ্য ছিল কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে কাজে লাগানো।

 

হামাদ বিন খলিফার মূল লক্ষ্য ছিল কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে কাজে লাগানো

হামাদ বিন খলিফার মূল লক্ষ্য ছিল কাতারের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে কাজে লাগানো

তিনি আমির হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন। এই পদ্ধতির নাম লিকুইফ্যাকশন বা তরলীকরণ। এই প্রক্রিয়ায় তরলীকৃত গ্যাস বড় বড় জাহাজে তেলের মতো পরিবহন করা যায়। গ্যাসকে তরলে পরিণত করার পর -১৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। কাতারের মতো উষ্ণ এলাকায় এই তাপমাত্রা ধরে রাখাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। 

পরবর্তীতে কাতার কর্তৃপক্ষ এই প্রযুক্তিতে আরো বিপুল অর্থায়নের ফলে তাদের উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়। সেই বিনিয়োগের কারণেই কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। কাতারের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে বিশাল বিশাল ইন্ড্রাস্টিয়াল কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কারণে এখানে গ্যাস উত্তোলন এবং তরলীকরণে পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় কম খরচ হয়। কাতারের একটি তরল গ্যাসের ট্যাঙ্ক ভরতে যে পরিমাণ খরচ হয়, আমেরিকায় তার উৎপাদন খরচ প্রায় চারগুণ বেশি। সস্তায় বিপুল পরিমাণ তরল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানির কারণেই কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের খেতাব অর্জন করতে পেরেছে।

কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানিকারক দেশ

কাতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি রপ্তানিকারক দেশ

খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে গেলে কাতারের অর্থনীতি যাতে ভেঙে না পড়ে, সেজন্য তৎকালীন আমির হামাড বিন খলিফা আরো একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ২০০৫ সালে কাতার ইনভেসমেন্ট অথোরিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কাতারের অর্থনীতিকে বহুমুখী করার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠান সারা পৃথিবীতে বিনিয়োগ করে থাকে। কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি ৪০টিরও বেশি দেশে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সিঙ্গাপুর থেকে সিলিকন ভ্যালি কোনো জায়গা কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি থেকে বাদ পড়েনি। লন্ডন শহরে ইংল্যান্ডের রানির চেয়েও বেশি সম্পদ আছে, কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটির। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে অফিস বিল্ডিং, হোটেল, অ্যাপার্টমেন্টসহ নানা ধরনের রিয়েল স্টেট প্রজেক্ট। 

লন্ডন শহরের শীর্ষ ১৫টি আকাশচুম্বী অট্টালিকার ৩৪ শতাংশ কাতারই মালিকানাধীন। অথচ যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত মালিকানায় রয়েছে মাত্র ২১ শতাংশ। এখানেই শেষ নয়, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের ২০ শতাংশের মালিক কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি। তারা রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এয়ারপোর্টেরও ২৫ শতাংশের মালিক। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ সর্বোচ্চ অফিস ইনভেস্টর হয়েছে কাতার। শুধুমাত্র নিউ ইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটানে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে কাতার কর্তৃপক্ষ।

 

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এয়ারপোর্টেরও ২৫ শতাংশের মালিক তারা

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এয়ারপোর্টেরও ২৫ শতাংশের মালিক তারা

কাতার ইনভেসমেন্ট অথোরিটি বিশ্বের বিখ্যাত বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার। ভক্সওয়াগন, বার্কলেস ব্যাংক, শেল, উবার, আইবারড্রোলা, টিফানি এন্ড কো এমনকি রাশিয়ার সরকারি তেল কোম্পানি রসনেফটও আছে এই তালিকায়। কাতার ইনভেসমেন্ট অথোরিটি ইতালিয়ান লাক্সারি ব্র্যান্ড ভ্যালেন্টিনো কিনে নিয়েছে। এরপর ২০১১ সালে তারা কিনে নেন ফ্রান্সের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব প্যারিস সেন্ট-জার্মেইন।

ধনী হবার পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করাও কাতারের অন্যতম উদ্দেশ্য। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের মনোজগতের উপনিবেশ গড়ে তুলতে গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব জনমত গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখতে কাতার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক। সারা পৃথিবী জুড়ে আলজাজিরার প্রায় ৮০টিরও বেশি নিউজ ব্যুরো রয়েছে। বিবিসির পরে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক।

 

আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক

আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক

কাতারি মালিকানাধীন আরো একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হলো বিইন মিডিয়া গ্রুপ। এই গ্রুপের অধীনে খেলা এবং বিনোদনভিত্তিক ৬০টি চ্যানেল আছে, যা বিশ্বের ৪৩টি দেশে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় সম্প্রচারিত হয়। এছাড়া আমেরিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিরাম্যাক্স ফিল্মসও কিনে নেয় কাতার সরকারি মালিকানাধীন বিইন মিডিয়া গ্রুপ। ২০০৩ সালে সৌদি আরব থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে কাতার নিজ উদ্যোগে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমেরিকা সেনাদের জন্য ঘাঁটি নির্মাণ করে। কাতারে অবস্থিত দুটি ঘাঁটিতে প্রায় ১১ হাজার আমেরিকান সেনা নিয়োজিত রয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে তুরস্ক এবং ইরানের সঙ্গে কাতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। 

ক্ষুদ্র এই দেশটির বৈশ্বিক প্রভাব কমাতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করা হলেও তাতে কাতারের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং কাতারের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। একদিকে কাতারের রাজপরিবার তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে। অন্যদিকে সৌদি শাসকগোষ্ঠী বিনিয়োগের চেয়ে বিলাসিতায় বেশি আগ্রহী। বেপারয়া বিলাসী জীবনযাপনে এর বেহিসাবী অর্থের অপচয় সৌদি রাজপরিবারের প্রতিদ্বন্দী কেউ নেই বললেই চলে।